তিনি ছিলেন চিকিৎসক ও ওষুধ বিক্রেতা। এক সময় তিনি কুফা ত্যাগ করে তুস নগরে গমন করেন। আর এ তুস নগরেই জাবিরের জন্ম হয়। জাবিরের পিতা উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত এই অপরাধে উমাইয়া খলিফা তাঁকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং হাইয়ানের পরিবার-পরিজনদের পুনরায় দক্ষিণ আরবে প্রেরণ করেন। দক্ষিণ আরবেই জাবির ইবনে হাইয়ান শিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষা লাভের প্রতি ছিল তাঁর পরম আগ্রহ। যে কোনো বিষয়ের বই পেলেই তিনি তা পড়ে শেষ করে এর ওপর গবেষণা করতেন। ফলে খুব অল্প সময়েই তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। শিক্ষা সমাপ্তির পর জাবির ইবনে হাইয়ান পিতার কর্মস্থান কুফা নগরীতে গিয়ে বসবাস করেন।
তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য ও বিভিন্ন পদার্থ আবিষ্কার করতে আরম্ভ করে খুব অল্প দিনের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ রসায়ন বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হন। জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান মৌলিক। তিনি বস্তু জগৎকে প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত করেন। প্রথম ভাগে স্পিরিট, দ্বিতীয় ভাগে ধাতু এবং তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ।তাঁর আবিষ্কারের ওপর নির্ভর করেই পরবর্তী বিজ্ঞানীরা বস্তু জগৎকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন। যথা-বাষ্পীয়, পদার্থ ও পদার্থবহির্ভূত। জাবির এমন সব বস্তু বিশ্ব সভ্যতার সামনে তুলে ধরেন যেগুলোকে তাপ দিলে বাষ্পায়িত হয় । এ পর্যায়ে রয়েছে কর্পূর, আর্সেনিক ও এমোনিয়াম ক্লোরাইড। তিনি দেখান কিছু মিশ্র ও যৌগিকপদার্থ; যেগুলোকে অনায়াসে চূর্ণে পরিণত করা যায়। নির্ভেজাল বস্তুর পর্যায়ে তিনি তুলে ধরেন সোনা, রুপা, তামা, লোহা, দস্তা প্রভৃতি।
জাবিরই সর্বপ্রথম নাইট্রিক এসিড আবিষ্কার করেন। সালফিউরিক এসিডও তাঁরই আবিষ্কার।তিনি ‘কিতাবুল ইসতিতমাস’ এ নাইট্রিক এসিড প্রস্তুত করার ফর্মুলা বর্ণনা করেন। নাইট্রিক এসিডের স্বর্ণ গলানোর ফরর্মুলা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম যে ‘এককোয়া রিজিয়া’ এ নামটিও তাঁরই প্রদত্ত। জাবির ইবনে হাইয়ান নানাভাবেই তাঁর রাসায়নিক বিশ্লেষণ বা সংশ্লেষণের নামকরণ বা সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। পাতন, ঊর্ধ্বপাতন, পরিস্রাবণ, দ্রবণ, কেলাসন, ভস্মীকরণ, গলন, বাষ্পীভবন ইত্যাদি রাসায়নিক সংশ্লেষণ বা অনুশীলন গষেণায় কী কী রূপান্তর হয় এবং এর ফল কী তিনি তাও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি চামড়া ও কাপড়ে রং করার প্রণালি, ইস্পাত প্রস্তুত করার পদ্ধতি, লোহা, ওয়াটার প্রুফ কাপড়ের বার্নিশ করার উপায়, স্বর্ণের পানিতে পুস্তকে নাম লেখার জন্য লোহার ব্যবহার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন।
জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি স্বর্ণ কিংবা পরশ পাথরের লোভী ছিলেন না। ধন-সম্পদের লোভ-লালসা তাঁকে সভ্যতা উন্নয়নে ও গবেষণার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্রও পদস্খলন ঘটাতে পারেনি।জাবির নেপোলিয়ানের আধ্যাত্মিকবাদ, প্লেটো, সক্রেটিস, এরিস্টটল, পিথাগোরাস, ডিমোক্রিটাস প্রমুখের গ্রন্থের সাথে পরিচিত এবং গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন।
লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি –
তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র, ইউক্লিড ও আল মাজেস্টের ভাষ্য,
দর্শন, যুদ্ধবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কাব্য সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। জ্যামিতি, তিনি দুই হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। তবে তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ । বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রণীত গ্রন্থাবলির মধ্যে রসায়ন ২৬৭টি, যুদ্ধাস্ত্রাদি ৩০০টি, চিকিৎসা ৫০০টি, দর্শন ৩০০টি, কিতাবুত তাগদির ৩০০টি, জ্যোতির্বিজ্ঞান ৩০০ পৃষ্ঠার ১টি, দার্শনিক যুক্তি খণ্ড ৫০০টি উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যু –
এই বিশ্বখ্যাত মনীষী ৮০৩ সালে আমাদের এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি বিজ্ঞানে যে অবদান রেখে গেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
0 Comments